বাংলা পঞ্জিকার অগ্রহায়ণের প্রথম দিনটি নওগাঁয় নবান্ন উৎসবের বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপিত হলো। নতুন ধান আর ফসলের আনন্দ ভাগাভাগি করার এই দিনটি এবারও বিশেষভাবে উদযাপন করল সংগীত নিকেতন, নওগাঁ। গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ঐতিহ্যের গুরুত্ব ছড়িয়ে দিতে পুরো আয়োজনটি ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ।
পহেলা অগ্রহায়ণ উপলক্ষে শনিবার (১৬ নভেম্বর) সকালে নওগাঁ সমবায় চত্বরে গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা ঘটে। সংগীত নিকেতনের শিল্পীদের পরিবেশনায় প্রাণবন্ত পরিবেশে শুরু হয় উৎসব। “এসো মিলি প্রাণে প্রাণে নবান্নেরই গানে গানে” প্রতিপাদ্য ধারণ করে আয়োজনটি নওগাঁ শহরের মানুষের মনে এক নতুন আবেগের সঞ্চার করে।
পরে নওগাঁ শহরের ডানা পার্কে দিনব্যাপী নানাবিধ আয়োজন করা হয়। গান, নৃত্য, প্রতিযোগিতা এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে পুরো উৎসব জুড়ে ছিল এক উৎসবমুখর পরিবেশ।
উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এতে শিশুদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করেন। বাচ্চাদের কণ্ঠে নবান্নের গান পরিবেশনা দেখে অভিভাবকদের চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যায়। অভিভাবকরাও এতে অংশ নেন, যা পুরো আয়োজনকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের খণ্ড চিত্র তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে বাঙালির নবান্ন উৎসবের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহ্যবাহী গানের পরিবেশনা ছিল দর্শনার্থীদের জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা।
খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উৎসবের আরও একটি রঙিন দিক উন্মোচিত হয়। শিশুদের জন্য আয়োজিত বেলুন ফাটানো, চকলেট কুড়ানো, চেয়ারে বসার খেলা এবং মার্বেল দৌড় তাদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। অভিভাবকদের জন্য বেলুন ফাটানো ও চেয়ারে বদলের মতো প্রতিযোগিতাগুলোও বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এই প্রতিযোগিতাগুলো শুধু আনন্দই দেয়নি, বরং উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্কের সেতু তৈরি করেছে।
আলোচনা সভায় সংগীত নিকেতন, নওগাঁর পরিচালক অখিল চন্দ্র সরকার এর সভাপতিত্বে বক্তব্য প্রদান করেন, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নওগাঁ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার চন্দন কুমার, তিনি বলেন, “নবান্ন কেবল একটি উৎসব নয়, এটি কৃষিজীবী মানুষের সংগ্রামের গল্প। নওগাঁ আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রফিকউদ্দৌলা রাব্বি বলেন, “নবান্ন উৎসবের প্রতিটি ধাপে ফুটে ওঠে বাঙালির ঐতিহ্য। সংগীত, আবৃত্তি ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা সেই ঐতিহ্যের সাথে নিজেদের আরও গভীরভাবে যুক্ত করতে পারি।”
হাতে খড়ির পরিচালক মাগফুরুল হাসান বিদ্যুৎ বলেন, “নবান্ন আমাদের মাটির কথা বলে, মানুষের কথা বলে। এমন উৎসব শুধু আনন্দ নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্বও। ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজন আরও বিস্তৃতভাবে করা উচিত।”
জহির রায়হার চলচিত্র সংসদ, নওগাঁ এর সাধারণ সম্পাদক রহমান রায়হান বাহাদুর বলেন, “আমাদের এই উৎসবগুলো শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং আমাদের শিকড়ের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। নওগাঁর মতো জায়গায় এমন উৎসব আয়োজন একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।”
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, তেতুলিয়া বি এম সি কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান, নওগাঁ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম এবং মানবাধিকার নাট্য পরিষদ নওগাঁ জেলার সভাপতি উত্তম সরকার, এবং ঐকতান এর সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন সহ নওগাঁর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।
পুরস্কার বিতরণের পর এক সুরমুখর পরিবেশে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। পুরো আয়োজনের মাধ্যমে নওগাঁর মানুষ একদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল তাদের শিকড়ের মাঝে।
নওগাঁয় নবান্ন উৎসব শুধু আনন্দ উদযাপন নয়, এটি মানুষের মধ্যে ঐতিহ্যের বোধ ও শিকড়ের প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। এমন আয়োজন ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকুক, এটাই সকলের প্রত্যাশা।